নেত্রকোনা শহর এখন শব্দ দূষণের শহর। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানবাহনের উচ্চ শব্দে নেত্রকোনা শহরের নাগরিক জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ। সহনীয় মাত্রার ২২ থেকে ৩৮ ডেসিবল বেশি শব্দের দূষিত মগড়ার রাতদিন হাবুডুবু খাচ্ছেন নগরবাসী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এ দূষণকে অনেকে বলছেন ‘শব্দ সন্ত্রাস’। শব্দ দূষণ প্রতিনিয়তই নাগরিক জীবনকে প্রভাবিত করছে। সকালে ঘর থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে আবার ঘরে ফিরে আসা অবধি শব্দ দূষণের যন্ত্রণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব থেকে বেশি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী নেত্রকোনা এখন আর চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় না। শোনা যায় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দ (বাসের শব্দ ৯৫ ডেসিবল ও মোটরসাইকেলের ৮৭ থেকে ৯০ ডেসিবল), মেশিনের শব্দ (৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল) এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে সৃষ্ট শব্দ। শুধু যে বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে শব্দ দূষণ হয়, তা নয়; বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও শব্দ দূষণ হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, নেত্রকোনা শহরের বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে কেবল গাড়ি চলমান অবস্থায়ই নয়, যানজটের সময়ও চালকরা অহরহ হর্ন বাজিয়ে চলেন। হর্নের শব্দে রাস্তার পাশে চলা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তেমনই একটি দৃশ্য দেখা যায়(১৯ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার শহীদ মিনার রাস্তার মোড়ে। শুধু এই মোড়েই নয়, নেত্রকোনার সকল সড়কে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলেন চালকরা,যার বেশিরভাগই বাজানো হয় অপ্রয়োজনে। কিন্তু চালকরা মনে করছেন, বিকট শব্দে হর্ন বাজানোর প্রয়োজন আছে। কেন অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো হয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে আলম শেখ নামে এক প্রাইভেটকার চালক বলেন, নিজেই দেখেন, বাসগুলো মোড়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে রিকশা। এটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে যে কয়েকবার হর্ণ না বাজালে কিছুতেই সামনে যাওয়া যাবে না। অন্যান্য শহরের মতো নেত্রকোনায় ও রয়েছে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা। এছাড়া রয়েছে কিছু নীরব ও মিশ্র এলাকা। সব এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা সমান নয়, আবার প্রতিটি এলাকার শব্দের জন্য নির্ধারিত মানমাত্রাও সমান নয়। নেত্রকোনাতে শব্দ দূষণের মাত্রা কোন পর্যায়ে আছে সেটা জানতে একটি গবেষণা করেছিলেন আলী আশরাফ নামে এক ব্যক্তি। তাঁর এ গবেষণায় শব্দ দূষণের ভয়াবহতার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি নেত্রকোনার ৩২টি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিজিটাল সাউন্ড মিটারের (ডিবি মিটার) সাহায্যে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেন। এসব স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে তেরীবাজার, আখড়া মোড়, শহীদ মিনার, মোক্তারপাড়া,সহ বেশ কিছু স্হান। এসব স্থানে শব্দের গড় তীব্রতা ৯০ ডেসিবল, যা আমাদের শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
নেত্রকোনা পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ পিপিএম বলেন, নেত্রকোনায় যানবাহন বাড়ছে,তার সাথে হাইড্রোলিক হর্ণের কারণে শব্দ দূষণও বাড়ছে। আমরা জরিমানা করার পাশাপাশি হাইড্রোলিক হর্ণ জব্দ করছি। পাশাপাশি মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করছি। এবিষয়ে জানা যায়, শব্দ দূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নীরব, আবাসিক, মিশ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০, শিল্প এলাকায় ৭৫, নীরব এলাকায় ৪৫, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও রাতের জন্য সর্বত্র ১০ ডেসিবেলের কম। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব জায়গায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিআরটিএ সূত্র জানায়, নেত্রকোনাতে ছোট বড় প্রায় দেড় লাখ যানবাহন চলাচল করছে। চলাচলকারী যানবাহনের প্রায় ৩৫ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। এসব যানবাহন কালো ধোঁয়া সৃষ্টি করছে ও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নেত্রকোনায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজের পাশে জোরে হর্ন বাজানো এবং মাইক বাজানো নিষেধ-সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। কিন্তু তা কেউ মানছে না। হাসপাতালকে নীরব এলাকা ঘোষণা করে শব্দের মানমাত্রা ৪৫ ডেসিবলের নিচে রাখার কথা থাকলেও তা মানছে না কেউ। আইনের তোয়াক্কা না করইে নেত্রকোনায় হাসপাতালের একশ মিটারের মধ্যে দ্বিগুণ মাত্রায় হর্ন বাজিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে যানবাহন। আর সেবা নিতে এসে শব্দ দূষণের কারণে রোগী ও স্বজনদের পড়তে হচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। শব্দ দূষণ থেকে রেহাই নেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাগুলোর। যানবাহনের কানফাটা শব্দে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরাও।