মধুমাধবী ফুলের কথা প্রথম শুনেছি নিসর্গী ও বিজ্ঞানলেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার কাছে। তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে ফুলটির বর্ণনা দিতেন। দেখতে কেমন, কী রং, কেমন গন্ধ ইত্যাদি। শৈশবে দেখা এই ফুল পরে আর কখনোই দেখেননি তিনি। এ নিয়ে তাঁর বেশ আক্ষেপ ছিল। তাঁর ধারণা ছিল, এই গাছ আমাদের প্রাকৃতিক আবাস থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর পর নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর সীমান্তে বনে গাছটি খুঁজে পান নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বোটানি বিভাগের এক অধ্যাপক। তিনি বন থেকে চারা সংগ্রহ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে রোপণ করেন। সেই গাছ গুলোতে এখন নিয়মিত ফুল ফুটছে। তাই নেত্রকোনার একটি সড়কে গিয়েই সরেজমিনে গাছটি দেখার সুযোগ হলো।
মধুমাধবী (Stixis suaveolens) ফুলের রং যেমন মনোমুগ্ধকর তেমনি তার সুবাস। এই রঙে আছে আভিজাত্য আর সুবাসে আছে মাদকতা। ফুল ফুটলে সুবাস অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। গাছটি মেঘালয়ে মধুমালতী নামে পরিচিত হলেও আমাদের দেশে সাধারণত মধুমঞ্জরি বা রেঙ্গুন ক্রিপারকেই এ নামে ডাকা হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে এই গাছ মধুমালা নামেও পরিচিত। এটি কাষ্ঠল লতার গাছ। আবার কখনো কখনো গুল্মজাতীয় ঝোপালো উদ্ভিদের মতো দেখা যায়। শাখা–প্রশাখা ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত। পাতা ১০ থেকে ৩০ সেমি লম্বা, উপবৃত্তাকার, দীর্ঘায়ত, পুরু, চকচকে, ওপরের অংশ গাঢ় সবুজ এবং নিচের অংশ ফ্যাকাশে সবুজ। পুষ্পবিন্যাস শীর্ষীয়, ১৫ থেকে ৩০ সেমি লম্বা, মখমলের মতো, মঞ্জরিপত্র রৈখিক, ২ থেকে ৪ মিমি লম্বা, ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত। ফুলের রং ফ্যাকাশে হলুদ বা সবুজাভ হলুদ, সুগন্ধি, আড়াআড়ি ১২ থেকে ১৮ মিমি লম্বা। পুষ্পাধার আড়াআড়ি আড়াই মিমি। বৃত্যাংশ ৫ থেকে ৬০ মিমি দীর্ঘ, পুরু, ধূসর সবুজ ও রোমশ। পুংকেশর ৩৮টি থেকে অসংখ্য, পুংদণ্ড ৫ থেকে ৬ মিমি লম্বা, রোমশবিহীন ও পরাগধানী কমলা হলুদ। গর্ভাশয় রোমশবিহীন, উপবৃত্তাকার ও কমলা বাদামি রঙের। ফুলের পর আসে ফল। এই ফল চীন ও পূর্ব ভারতে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বীজ ডিম্বাকার, রসালো অংশ হলুদ, সুগন্ধি ও মিষ্টি। ফুলের মৌসুম বসন্তকাল।
আরো জানা গেছে, এই মধুমাধবী নেত্রকোনা ছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। ভারতের মেঘালয় ,সিকিম, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে মিশ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় বনে সুগন্ধি এই ফুল পাওয়া যায়। এ ছাড়া নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও চীনেও সহজলভ্য। গুল্ম শ্রেণির জঙ্গল ও বাঁশের অরণ্য গাছটির প্রিয় আবাস। পরিবেশবিদরা মনে করছেন এই বীজ থেকে সহজেই চারা হয়। আমাদের পার্ক ও উদ্যানগুলোতে এই গাছ রোপণ করা প্রয়োজন। তাতে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি প্রজাতি সংরক্ষণও হবে।