নেত্রকোনা জেলাজুড়ে সামাজিক অনুষ্ঠান, বনভোজন এবং দোকানে খাবার ও পানীয় এমন কি চায়ের দোকানেও “চা-কপি” পরিবেশন করতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে থার্মোকলের ‘ওয়ান টাইম’ বাসন-কোসন ও গ্লাস। বিশেষ করে নেত্রকোনার বিভিন্ন মার্কেটের অলিগলিতে অবস্থিত পাইকারি দোকানগুলোতে মিলছে এসব প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাস, প্লেট, চামচ ও বক্স। দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এসব ক্ষতিকর পণ্য। সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উদাসিনতায় প্রচারণা ও সচেতনতার অভাবে এই পণ্য বিক্রি এবং ক্ষতিকর দিকগুলো রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। ফলে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বিক্রি ও ব্যবহার অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েই চলেছে। যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহার শেষে আর কোনো কাজে লাগে না বা ফেলে দেওয়া হয় সেগুলোই ওয়ান টাইম প্লাস্টিক হিসেবে পরিচিত। রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, এয়ারলাইনস, সুপারশপ, চায়ের দোকান, ফাস্টফুড এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ আধুনিকতার অজুহাতে দিন দিন এসব ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার করেই চলেছেন। জরিপে বলছে, বাংলাদেশে বছরে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৮৬ হাজার ৭০৭ টন। শহর এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
পলি ইথায়লিন ও পলি প্রপাইলিন বা এর কোনো যৌগ মিশ্রণে তৈরি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা মূলত নিষেধ। কেননা এটা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (৬)-এর ‘ক’ ধারার লঙ্ঘন। এসব পণ্য বিক্রির জন্য বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীর বিভিন্ন দণ্ডও নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ওয়ান টাইম প্লাস্টিক রিসাইকেল করা খুবই জটিল বা করা যায় না বললেই চলে। ব্যবহার করা এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বড় একটা অংশ শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। পড়ে এসব প্লাস্টিক পণ্যের স্থান হয় নদী-নালা-খাল-বিল সহ ড্রেনে। আর শহরের ড্রেনগুলোতে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের ছড়াছড়ি। ফলে বছরের পর বছর পরিবেশে টিকে থেকে এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে। আর প্লাস্টিক দূষণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর। জ্ঞাত-অজ্ঞাতভাবে বর্তমান প্রজন্মের বড় একটা অংশ প্রতিনিয়ত ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন। ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশও আছে। এবিষয়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও খোন্দকার দিলারুজ্জামান এর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার এক বছরের মধ্যে নিষিদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
একইসঙ্গে পলিথিন ও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে বাজার তদারকির পাশাপাশি পলিথিন উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি জব্দ ও কারখানা বন্ধের নির্দেশও প্রদান করেন। পাশাপাশি ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সারাদেশে একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের বিপরীতে নিরাপদ বিকল্প কি হতে পারে, সে বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছিলেন আদালত। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রচারণা ও সচেতনতা অভাবে পরিবেশে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। গবেষণার তথ্য মতে, প্লাস্টিকের কাপে থাকা টক্সিক পদার্থ মুখ ও লিভারের ক্যানসারের অন্যতম কারণ। এই ক্ষতিকর পদার্থ গরম পানির সঙ্গে সহজেই মিশে যায়। নারী-পুরুষের হরমোন কার্যকারিতায় বাধা প্রধান করে এই ক্ষতিকর পদার্থ। এছাড়া হার্ট, স্তন ক্যানসার, মস্তিষ্ক ও ত্বকের ক্ষতি বয়ে আনে। মানবদেহে ক্যানসার হওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো প্লাস্টিক দূষণ।কিন্তু কে মানে কার কথা, দেশে-বিদেশে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে জোর দাবি ওঠেছে। ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের দূষণ বন্ধে দুইটি উপায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে—এক, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং দুই, প্রচলিত পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।