প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ৫:০৩ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ অক্টোবর ২৭, ২০২৪, ১২:০৮ অপরাহ্ণ
নেত্রকোনায় পাউবোর যোগসাজশে বিল খননের নামে কোটি টাকার বালু ব্যবসা
নেত্রকোনার পূর্বধলায় ‘মরা গাং বিল’ নামে একটি বিল খননের নামে কোটি কোটি টাকার বালু ব্যবসায় অভিযোগ উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। বিলের আশপাশে কোনো কৃষি জমি না থাকলেও শুধুমাত্র বালু ব্যববসার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়ে এমন জনস্বার্থ বিরোধী প্রকল্প হাতে নিয়েছে পাউবো। এমনটাই অভিযোগ গ্রামবাসীর। গত ১০ মাসে ৮-৯ লাখ ঘনমিটার বালু তুলে বিক্রি করলেও পাউবোর খাতায় সেই হিসেব ১৮ হাজার ঘনমিটার। কেটি কোটি টাকার বালু ব্যবসায় ঠিকাদারের অংশীদার পাউবো কর্মকর্তারা। ফলে বালুর হিসেব এগোচ্ছে না বলে জানান স্থানীয়রা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক ডজন বাংলা ডেজার বসিয়ে গত ৮-৯ মাস ধরে পূর্বধলা উপজেলার পাটলী এলাকায় ‘মরা গাং বিল’ নামে ওই বিল খনন করা হচ্ছে। এতে বিলের পাড়ে বসবাসরত ৪০-৫০টি বাড়ির একাংশ ভেঙে বিলীন হয়েছে। নলকূপ, টয়লেটসহ বাড়ির আঙ্গিনা ধসে পড়েছে বিলে। টয়লেট, নলকূপ বিলীন হয়েছে বিলের গর্ভে। ইতোমধ্যে দুই-আড়াইশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া কয়েকশ ঘর বাড়ি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে সারাদিন ধরে চলতে থাকা এক ডজন ডেজারের বিকট শব্দে গ্রামের কয়েকশ পরিবারের হাজারও মানুষের জীবন অতিষ্ট। শব্দের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাও নষ্ট। বারবার অভিযোগ দিলেও পাউবো-ঠিকাদার কেউই শুনছেন না তাদের কথা।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, কৃষি কাজে সেচ সুবিধার স্বার্থে জেলার পূর্বধলা উপজেলার ধলামুলগাঁও ইউনিয়নের পাটলী গ্রামের সামনে থাকা ‘মরা গাং বিল’ নামে বিলটি খননের উদোগ নেয় পাউবো। ৪৫০ মিটার দৈর্ঘ্য, ৯২ মিটার প্রস্ত ও জায়গা ভেদে ৩ মিটার ও দুই গভীরতায় ওই বিলটি খনন করা কথা। এ কাজের বরাদ্দ এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কাজটি পায় চট্টগ্রামের ইউনি অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে কাজটি ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনে নেয় নেত্রকানা শহরের শাহীনুর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে কাজটি শুরু হয়, ১৫ জুন শেষ হওয়ার কথা। তবে যথা সময় শেষ না হওয়ায় ৬ মাসের সময় বৃদ্ধি করা হয়। সেই হিসেবে চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বালু ব্যবসার লোভে কাজের অগ্রগতি কম দেখাচ্ছে পাউবো। তাদের হিসেবে এ পর্যন্ত পাঁচ ভাগের এক ভাগও কাজ শেষ হয়নি। এ প্রকল্প থেকে ৩৪ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন হবে বলে ধারণা করে পাউবো। সেই হিসেবে প্রতি ঘনফুট ৫০ পয়সা ধরে ১৭ লাখ টাকায় সেই বালু ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে পাউবো। তবে লাভজনক বালু ব্যবসার কারণে দশগুণ বেশি বালু উত্তোলন করে বিক্রি করার পরও পাউবোর খাতায় বালুর হিসেব মাত্র ১৮ হাজার ঘনমিটার। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫ বছরেও বিল খনন শেষ হবে না।
রবিবার (২৭ অক্টোবর) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মরা গাং বিলটি পাটলী গ্রামের নেত্রকোনা-পূর্বধলা সড়ক থেকে ৫০০ গজ ভেতরে। ওই বিল থেকে তোলা বালু সড়কের পাশে পাঁচটি বড় বড় ডাইকে (বালু জমানোর বিশাল গর্ত) বিশাল স্তুপে জমিয়ে রাখা হয়েছে। ডাইক থেকে ৪-৫টি ভ্যাকু দিয়ে একের পর এক ট্রাকে লোড করা হচ্ছে বালু। প্রতি ট্রাক ৪-৫ হাজার টাকা দরে এসব বালু বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সাইটে। প্রতিদিন এখান থেকে কয়েক লাখ টাকার বালু বিক্রি হয় বলে নিশ্চিত করেন স্থানীয়রা। খনন কাজের পাশে ঠিকাদারকে পাওয়া যায়নি। তবে একাধিক লেবারকে পাওয়া গেলেও তার এ বিষয়ে কথা বলেতে রাজি হননি। গত ১০ মাসে ১৮ হাজার ঘনমিটার বালু উত্তোলনের কথা পাউবো জানালেও এ পর্যন্ত ৮-৯ লাখ ঘনমিটার সমপরিমাণ বালু বিক্রি করেছে ঠিকাদার। বর্তমানে ডাইকে জমানো বালুর পরিমাণ এক লাখ ঘনমিটার হবে বলে ধারণা করেন স্থানীয়রা। বিল থেকে মোট ১ লাখ ১০ হাজার ঘনমিটার বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত ৮-৯ লাখ ঘনমিটার বালু বিক্রি করেছে ঠিকাদার। তবে পাউবোর খাতায় সেই হিসেব কমে ১৮ হাজার ঘনমিটার মাত্র।
পাটলী গ্রামের বিল পাড়ের বাসিন্দা আলকাছ মিয়া বলেন, বিলের চারপাশে এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কৃষি জমি নাই। তাহলে কার স্বার্থে এই বিলটি খনন করছে সরকার? বাড়ি-ঘর তো ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিলের গর্ভে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এক ডজন সেলু মেশিনের শব্দে আমরা শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছি। পোলাপানের পড়াশোনা শেষ। শব্দে তারা পড়তে পারে না। কতবার অভিযোগ দিয়েছি কেউ শুনেনি আমাদের কথা। একই গ্রামের মিনা আক্তার বলেন, আমাদের নলকূপ, টয়লেট ইতোমধ্যে ভেঙে পড়ে গেছে বিলে। বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়েছে। আর কয়দিন এভাবে চললে বসত ভিটাও ভেঙে পড়বে। মেশিনের শব্দে ৮-৯ মাস ধরে যন্ত্রণার মধ্যে আছি। ঠিকাদারকে মেশিন বন্ধ করতে বললে নানা হুমকি দেয়। বলে সরকারি অনুমতি আছে কথা বললে মামলা করবে। কত জায়গায় অভিযোগ দিয়েছি কোনো কাজ হয় না। স্থানীয় ঠিকাদার শাহীনুর ইসলাম বলেন, পাউবোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিলটি খনন করা হচ্ছে। বালু টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়েছে। বাড়ি-ঘর ভাঙবার বিষয়টি সঠিক নয়। তারপরও প্রশাসন ও পাউবোর লোকজন বিষয়টি তদারকি করে দেখছেন। তারা সে বিষয়টি তদন্ত করছেন।
এ বিষয়ে রবিবার (২৭ অক্টোবর) পূর্বধলার দায়িত্বে থাকা পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, খননের মাধ্যমে ১ লাখ ১০ হাজার ঘনমিটার (৩৪ লাখ ৮৫ হাজার ঘনফুট) বালু উত্তোলনের কথা। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ঘনমিটার বালু উত্তোলন হয়েছে। খননের কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে বাড়ি-ঘর ভাঙার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী (পাউবো) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, খননের মাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিলামে ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমার সার্ভে করেছিলাম তখন বাড়ি-ঘর ভাঙার কোনো তথ্য পাইনি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুনরায় সার্ভে করে দেখা হবে। বাড়ি-ঘর ভাঙলে তার ক্ষয়ক্ষতি ঠিকাদারকে বহন করতে হবে। তবে বালু ব্যবসার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। আশপাশে কৃষি জমি না থাকলেও কার স্বার্থে এই বিল খনন? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি। তার দাবি- খনন হলে বিলে পানি থাকবে সেখান থেকে কৃষকরা উপকৃত হবেন।বিষয়টি অবহিত করলে জেলা প্রশাসকক বনানী বিশ্বাস বলেন, জনভোগান্তি সৃষ্টি হয় এমন কাজ কখনই করা যাবে না। ঘর-বাড়ি বিলীন, শব্দ দূষণে মানুষের ভোগান্তিসহ সবগুলো অভিযোগ খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের সত্যতা পেলে খনন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ শরীফ। নির্বাহী সম্পাদক : তাসেরা তাজরীন। বার্তা সম্পাদক : মোহাম্মদ আমান উল্যা।সম্পাদক ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: এমএস প্লাজা (৩য় তলা)২৭/সি/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০।
তুহিন
প্রেস ২১৯/২, ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল হতে মুদ্রিত। ফোন:
+৮৮-০২-৪১০৫২৪৯৪, মোবাইল: ০১৯৭১-৮৪২৩৬৫, ০১৭১১৮৪২৩৬৫, বার্তা: ০১৭৩১-৮৫৭১৮৬
,anantabanglanews24@gmail.com
Copyright © 2024 দৈনিক অনন্ত বাংলা. All rights reserved.