তৌহাখানা পারসিয়ান শব্দ যার আভিধানিক অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। ৪০০ বছর আগের তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হলো মোগল তৌহাখানা। শাহ সুজার তৌহাখানাটি একটি তিনতলা-বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ। গৌড়-লখনৌতির পিরোজপুর এলাকায় একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ভবিনটি ঐতিহ্যবাহী তোহাখানা নামে পরিচিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী তৌহাখানা কমপ্লেক্স বা তৌহাখানা অবস্থিত।বঙ্গ সুলতান শাহ সুজা তার মুরশিদ সৈয়দ শাহ নেয়ামতউল্লাহর উদ্দেশ্যে শীতকালীন বসবাসের জন্য ফিরোজপুরে তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে এ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে শাহ সুজাও এখানে এসে বাস করতেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বাংলার সুবাদার থাকাকালে ১৬৩৯-১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে মতান্তে ১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে তার মুরশিদ হজরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর প্রতি ভক্তি নিদর্শনের উদ্দেশ্যে তাপনিয়ন্ত্রিত ইমারত হিসেবে তোহাখানা নির্মাণ করেন।
জনশ্রুতি আছে, শাহ সুজা যখন ফিরোজপুরে শাহ নেয়ামতউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তখন ওই ইমারতের মধ্যবর্তী সুপ্রশস্ত কামরাটিতে বাস করতেন। তোহাখানা কমপ্লেক্সের ভেতরে নাম না জানা অনেক সমাধি দেখা যায়। যাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তবে এদেরকে হজরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর খাদেম বা সহচর বলে ধারণা করা হয়।গৌড়ের মতো সুপ্রাচীন স্থাপত্যকর্ম তৌহাখানা ছাড়া অন্যত্র তেমন দেখতে পাওয়া যায় না।
এর ছাদ এবং দেয়ালগুলো কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তৈরি। মসজিদ এবং তোহাখানা উভয়েই ‘দাফে-উল-বালাহ’ নামক জলাধারের পাশে অবস্থিত। দুটি বাঁধানো সিঁড়ি জলাধারের পানির নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। মূল প্রাসাদের উত্তর-পশ্চিম দিকে আরও দুটি ভবন রয়েছে। এদের মধ্যে নিকটস্থটি হলো তিন গম্বুজ-বিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং অন্যটি হলো বাঁধানো বারান্দাসহ একটি গম্বুজ-বিশিষ্ট সমাধি। ভবনগুলো প্রায় একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এদের একত্রে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়।ভবনটি মূলত ইট দ্বারা নির্মিত। তবে দরজার চৌকাঠের জন্য কালো পাথর এবং সমতল ছাদের জন্য কাঠের বিম ব্যবহৃত হয়েছে। ভবনটিকে পশ্চিম দিক থেকে দেখলে একতলা বলে মনে হতে পারে, তবে পূর্ব দিক থেকে দ্বিতল বলেই মনে হয়। ঘরগুলো থেকে সৃষ্ট সুড়ঙ্গপথ প্রসারিত হয়ে জলাধারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ভবনের পশ্চিমে একটি হাম্মাম (গোসলখানা) রয়েছে, যাতে পানি সরবরাহের জন্য রয়েছে অষ্টভুজাকৃতির একটি কূপ। প্রাসাদের উত্তর দিকে একটি ছোট্ট পারিবারিক মসজিদ রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে একটি খোলাঘর যা অষ্টভুজাকার একটি দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত।
এ দুর্গটি সম্ভবত প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই অষ্টভুজাকার মিনারটি তাহখানা কমপ্লেক্সকে পূর্ণতা দান করেছে। প্রাসাদটি মূলত মুঘল স্থাপত্যের কারুকার্যের আদলে প্লাস্টার ও সৌন্দর্যম-িত করা হয়েছে।তৌহাখানা কমপ্লেক্সটি সুলতানি যুগের নগরে মুগল রীতির স্থাপত্য নিদর্শনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থাপত্য বাংলায় প্রথম। এ ধরনের কমপ্লেক্সের সূত্রপাত হওয়ার পর ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে এরূপ প্রাসাদ, মসজিদ অথবা সমাধিসৌধ সংবলিত কমপ্লেক্স একটি প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়।